আজ ২৮ মে ২০২৪ মঙ্গলবার সকাল ১১:০০ টায় সিরডাপ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টারে পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক নাগরিক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়াটারকিপার অ্যালায়েন্স-এর আঞ্চলিক সদস্য ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ -এর যৌথ উদ্যোগে “উপকূলের কৃষি ও মৎস সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে করণীয়”শীর্ষক একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বেসরকারি উপদেষ্টা এবং ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর সহ-আহ্বয়ক এমএস সিদ্দিকী এর সভাপতিত্বে ও ধরার সদস্য সচিব ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ঢাকা আর্চ ডায়োসিস এর আর্চবিশপ বিজয় নিসফরাস ডি’ক্রুজ ওএমআই, মাননীয় সাবেক সংসদ সদস্য (সংরক্ষতি মহিলা আসন, খুলনা) এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক সদস্য এবং ব্রতী সমাজকল্যাণ সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ প্রমূখ।
এসময় ইলিশ এর উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শীর্ষক গবেষণালব্ধ ফলাফল উপস্থাপন করেন ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর গবেষণা প্রধান মো: ইকবাল ফারুক, তরমুজ চাষে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শীর্ষক গবেষণালব্ধ ফলাফল উপস্থাপন করেন এফএসএল পরিবেশ বিশেষজ্ঞ রফিকুল ইসলাম, এবং কৃষি ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শীষর্ক গবেষণালব্ধ ফলাফল উপস্থাপন করেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো: আশিকুর রহমান।
সভায় তৃণমূলের নেতৃবৃন্দের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করেন উপকূল রক্ষায় আমরা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র, সুন্দরবন রক্ষায় আমরা আন্দোলনের সমন্বয়ক নূর আলম শেখ, কক্সবাজারের পরিবেশকর্মী ফরিদুল আলাম শাহীন, পেকুয়া কক্সবাজারের পরিবেশকর্মী দেলোয়ার হোসেন, মোংলার মৎসজীবী রশিদ হাওলাদার, পাথরঘাটার পরিবেশকর্মী শফিকুল ইসলাম খোকন প্রমূখ।
গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার বলেন, সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড মানুষের জন্য। তবে উন্নয়ন করতে গিয়ে যদি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে প্রধানমন্ত্রী তা হতে দেবেন না। গঠনমূলক সমালোচনা থাকলে সরকার আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেন। আমি উপকূলের মানুষ, কৃষির মানুষ। সরকার কাজ করছে, বরাদ্দ দিচ্ছে। কিন্তু এই বরাদ্দ ব্যয়ে যাতে স্থানীয়ভাবে দুর্নীতি না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। সরকারের পাশাপাশি আমরাও ভূক্তভোগী। তাই আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
এমএস সিদ্দিকী বলেন, উন্নয়ন হতে হবে কিন্তু উন্নয়ন কর্মকান্ডের লাভ-ক্ষতির গবেষণা করতে হবে এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। আমরা জেনেছি, মে থেকে জুন ৬৫ দিন, অক্টোবরে ২২ দিন প্রজননক্ষম মা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। কিন্তু সেই সময়ে ভারতের জেলেদের উপর কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকায় তাঁরা বঙ্গোপসাগরে উভয় এলাকার ইলিশ মাছ অবাধে শিকার করছে। তাতে আমাদের দেশের মৎস সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারকে এই বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি যাতে দুই দেশের মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময়কাল সমন্বয় করা যায়।
শরীফ জামিল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ সাইক্লোনগুলো আরো শক্তিশালী হবে আর ঘনঘন আসবে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু এই ঘূর্ণিঝড় রেমাল থেকে আমরা দেখতে পেলাম আগের চেয়ে ধীর গতিতে চলছে আর দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করছে। এটাও জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অভিঘাত। পায়রা বন্দর এবং তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লাবাহী জাহাজ যাতায়াতের কারণে মৎসজীবীরা মাছ শিকার করতে পারছে না। বিরূপ প্রভাব পড়ছে এলাকার তরমুজসহ সমগ্র কৃষিখাতের উপর।
বিজয় নিসফরাস ডি’ক্রুজ বলেন, উপকূলবাসীর কূল নেই। মানুষ বঞ্চিত হবে, শিক্ষা পাবে না, খাবার পাবে না এটা হতে পারে না। আমাদের সবার জন্য চিন্তা করতে হবে। অন্যের ভালো চিন্তা করতে হবে। অন্যের ভালো করতে না পারলেও মন্দ যেন না করি। মানবজাতিকে একসঙ্গে চলতে শিখতে হবে, নইলে মানবজাতি ধ্বংস হবে। এই বাংলাদেশ আরো মানবিক হয়ে উঠুক। সকলের কল্যাণ হোক।
শারমিন মুরশিদ বলেন, উন্নয়নকাজে সরকারকে কমিউনিটির মতামত নিতে হবে। উপকূলের জন্য কৌশল ঠিক করতে হবে। নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে। আমরা দেখেছি বাধের জন্য অর্থ বরাদ্দ হলো কিন্তু কাজ দেখতে পেলাম না। উপকূলের মানুষ যাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে তার জন্য অবশ্যই বাধ নিশ্চিত করতে হবে।
নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, লোনা পানিতে চিংড়ি চাষ না করে মিষ্টি পানিতে বাগদা চাষ করেও লাভবান হওয়া যায়। চিংড়ি ঘেরের জন্য লোনাপানি জমিতে ঢোকানোর ফলে কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে এবং কৃষক তার কাজ হারাচ্ছে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে মানুষ মাইগ্রেট করে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে চলে যাচ্ছে জীবিকার তাগিদে। বসতি এবং ফসলি এলাকায় লবণপানি নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। প্রাণ-প্রকৃতিকে বাঁচিয়েই আমরা বেঁচে থাকতে চাই।
নূর আলম শেখ বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূল। প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো মোট ক্ষতি হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। সুন্দরবন বুক পেতে আমাদেরকে রক্ষা না করলে ক্ষতির মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেতো বলে ধারণা করা যায়। সুন্দরবনের পাশে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশের ক্ষতিসাধন করছে। পাওয়াপ্ল্যান্টের আশেপাশে নদীর পানি খেয়ে গরু-ছাগল মারা যাচ্ছে। ইলিশ কমে যাচ্ছে পশুর নদীর। পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনষ্টকারী উন্নয়ন থেকে আমাদেরকে সরে আসতে হবে। উপকূলকে সংরক্ষণ করতে হবে।
ফরিদুল আলাম শাহীন বলেন, পাহাড়-সাগর-বনে বৈচিত্র্যপূর্ণ হলো আমাদের কক্সবাজার। একসময়ে কক্সবাজারের খাদ্যপণ্য অন্যান্য এলাকায় যেত। কিন্তু গত ৩ দশকে কাটা হয়েছে ১১৯ টি পাহাড়। ভরাট করা হয়েছে খাল-নদী। কমেছে কৃষি জমির পরিমাণ। এভাবে কৃষিজমি কমতে থাকলে ৫০ বছর পরে কক্সবাজারে আর কোন কৃষিজমি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে আমাদের স্থানীয় মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের লবণ চাষ। কক্সবাজারের যে ৬০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হতো তার মধ্যে ২০ হাজার একর অধিগ্রহণ করা হয়েছে মেগাপ্রকল্পে। কোহেলিয়া নদী ভরাট করে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। নদীতে এখন মাছ নাই, আছে শুধু প্লাস্টিক, পলিথিন আর কয়লা বিদ্যুতের বর্জ্য।
রশিদ হাওলাদার বলেন, পশুর নদীতে জাহাজ আসে। কয়লা পড়ে, ময়লা পড়ে, কার্গো ডুবে। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়। এতে আমরা মৎসজীবীরা অনেক কষ্টে আছি। এছাড়া বাংলাদেশে আমরা ৬৫ দিন আর ২২ দিন মাছ ধরতে পারি না। কিন্তু সেই সময়ে ভারতের মৎসজীবীরা ঠিকই মাছ ধরে নিয়ে যায়।
শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীতে ডুবোচর তৈরি হওয়ার ফলে ইলিশের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ার কারণে নদীর পানির তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাছের প্রজননক্ষেত্র। আমাদেরকে এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
এছাড়াও উপকূল থেকে আসা পরিবশকর্মী, কৃষক, মৎসজীবীগণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এবং উপকূল অঞ্চলে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার ফলে তাদের কৃষি এবং মৎস সম্পদের সমস্যা তুলে ধরেন। তারা বলেন, উপকূলের মানুষকে আর জীববৈচিত্র্যকে বাঁচাতে হলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সামনে আসা সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করার পাশাপাশি উপকূলের কাছাকাছি এলাকাগুলো থেকে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র অপসারণ করতে হবে।