আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস ২০২৫ উদযাপন উপলক্ষে ১৩ মার্চ ২০২৫, বৃহস্পতিবার, সকাল ১১ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)’র উদ্যোগে “বাংলাদেশের নদ-নদীর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ” শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ধরা’র সহ-আহ্বায়ক এম এস সিদ্দিকী-এর সভাপতিত্বে এবং ধরা’র সদস্য সচিব শরীফ জামিলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এবং মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি)’র সাবেক চেয়ারম্যান, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও ধরা’র উপদেষ্টা ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার।
সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স-এর সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশাহিদা সুলতানা; পশুর রিভার ওয়াটারকিপার মো. নূর আলম শেখ ও খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল। এছাড়াও সভায় উপস্থিত নদীপাড়ের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বুড়িগঙ্গা নদীমোর্চার সদস্য জাহাঙ্গীর আদেল, মোঃ সেলিম, মানিক বেপারি, ইশরাত জাহান লতা, বালু নদীমোর্চার জান্নাতী আক্তার রুমা, তুরাগ নদীমোর্চার আমজাদ আলী লাল, নদীকর্মী ইসমাইল গাজী, সাংবাদিক অনির্বান শাহরিয়ার প্রমুখ।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আনু মুহাম্মদ বলেন, নদীর বিপদ মানে বাংলাদেশের বিপদ। নদী না থাকলে বাংলাদেশ থাকবে না। নদীর বিপন্নতার তিনটি মূল কারণের প্রথমটি হলো উজানের দেশ ভারত। তাদের সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো মরে যাচ্ছে। জাতিসংঘের পানি কনভেশনে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেনি এই ভারতকে খুশি রাখতে। দ্বিতীয় কারণ হলো সরকার নিজেই। সরকারের প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নদীর বিনাশ করছে। আর তৃতীয় কারণ হলো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সমাজের প্রভাবশালী গোষ্ঠী। নদী বাঁচাতে তিনি জাতীয় ঐক্যমত্যের আহবান জানিয়ে বলেন, এই নদীকৃত্য দিবসেই সরকারকে জাতিসংঘের ১৯৯৭ এর পানি কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করতে হবে। সরকারের নদী বিনাশী সকল সিদ্ধান্ত ও প্রকল্পসমূহকে বাতিল করে নদী কমিশনের প্রণীত সুপারিশ অনুযায়ী দখল উচ্ছেদ করতে হবে এবং নদী রক্ষায় ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ পুনঃবিশ্লেষণ করে নতুন করে প্রণয়ন করতে হবে।
মূল বক্তব্যে ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, সরকারে কে রয়েছেন সেটার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সরকার পাবলিক প্রপার্টি রক্ষা করতে পারছেন কি-না। নদী হলো পাবলিক প্রপার্টি আর সেই নদীকে রক্ষা করা মানুষের দাবি। নদী ধ্বংস করা ফৌজদারি অপরাধ। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এখনো অপ্রতিরোধ্য গতিতে নদী দখল চলছে। নদীর কোন দল নাই, কোন ধর্ম নাই। নদী সবার জন্য। নদী, পানি, পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। নদী রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। নদী একটি জীবন্ত সত্তা। একে গলা টিপে হত্যা করা যাবে না। নদীর জমি কখনো খাস হয় না। নদীর জমি নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। আগামী ১ মাসের মধ্যে দখলদারদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। নদীভিত্তিক গবেষণা হতে হবে এবং নদী বাঁচাতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানতে হবে।
সভাপতির আলোচনায় এমএস সিদ্দিকী বলেন, নদী দখলের প্রক্রিয়া কি? নদীর রক্ষক সরকার। এটি লিজ দেন জেলা প্রশাসক। নদীর পাড়ে শিল্প কারখানা তৈরি হয়। তার জন্য জেটি তৈরি করা হয়। জেটি তৈরি জন্য নদীর জমি লিজ দেওয়া হয়। এখানেই শুভঙ্করের ফাঁকি। আমাদের গোড়ার গলদ ঠিক করতে হবে নদীকে বাঁচাতে হলে।
ধরা’র সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, আমাদের দেশ, নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের নদীগুলো জালের মতো ছড়িয়ে আছে দেশব্যাপী। আমাদের সবকিছু নদীর স্বাস্থ্যের উপর নির্ভরশীল। ভারত একতরফাভাবে উজানের নদীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। নদীগুলোকে প্লাবন এলাকার দিকে যেতে দিতে হবে। উচ্ছেদ পরে করেন, আগে নদী দখল বন্ধ করেন দয়া করে। নদীকে বাঁচতে দিন। দেশের কোন নদী ভালো নেই। বিভাগ, জেলা, উপজেলা নদী রক্ষা কমিটিগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নদীর সীমানা চিহ্নিত করার সময় নদীর জায়গা পরিবর্তিত হলে পরিবর্তিত জায়গাগুলোকে নদীর সীমানার আওতায় আনতে হবে। দখল কিভাবে উচ্ছেদ হবে তা আইনে বলা আছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী শক্তিশালী ও কার্যকর নদী কমিশন ও নদী কমিশন আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করুন।
বিআইপি’র সভাপতি ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, সম্প্রতি যৌথ নদী কমিটির মিটিং হয়েছে ভারতে। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেছেন। উজান থেকে প্রয়োজনীয় পানি না এসে আসছে দূষণ। যৌথ নদীর পানির পূর্ণ হিস্যার জন্য কমিশনকে আরো সক্রিয় হতে হবে। ৬৬ হাজার দখলদারকে উচ্ছেদের কাজ হঠাৎ কেন বন্ধ হয়ে গেলো? অনেক রাজনীতিক এবং ক্ষমতাবানেরা নদী দখলের সাথে যুক্ত ছিলেন। রাষ্ট্রীয় আবরণে তারা নদীকে ধর্ষণ করেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরও অবস্থার বদল হয়নি। দূষণকারীরা জীবন্ত সত্তাকে হত্যার সাথে জড়িত। একমাত্র গণমানুষের বন্দোবস্তই পরিবর্তন আনতে পারে। নদী রক্ষা করতে আমাদের একত্রিত হতে হবে।
ড. মোশাহিদা সুলতানা বলেন, সরকার যেখানে ব্যর্থ হয় সেখানে নিয়ন্ত্রণ বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়। আমাদের নদীগুলো বাজারি প্রক্রিয়ায় পণ্যে পরিণত হয়েছে। নদী সম্পৃক্ত যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানীয় গণমানুষের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। দূষণের প্রক্রিয়ায় একইরকমভাবে শুধুমাত্র মুনাফার জন্য সুবিধা দিয়ে নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে শিল্পকারখানা।
মো. নূর আলম শেখ বলেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ১০০৮ টি নদীর হিসাব পূর্ণাঙ্গ নয়। শুধু সুন্দরবনের ভেতরেই প্রায় চারশত খাল-নদী রয়েছে। সুন্দরবনে নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরা হচ্ছে আর সেই সাথে হত্যা করা হচ্ছে জলজপ্রাণীগুলোকেও। রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত করছে পশুর নদী আর সুন্দরবনকেও। সেখানকার কৃষক ও জেলেরা জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের দাবিতে। আমি তাদের পক্ষ থেকে পশুর নদী ও সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের দাবি জানাই।
তোফাজ্জল সোহেল বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নদীর ভূমিকা ছিল সবচে’ বেশি কিন্তু আজ আমাদের নদীর কোন স্বাধীনতা নাই। হাওড় এলাকার শিল্পের সকল বর্জ্য নদীর পানিতে এসে পড়ছে। পানি আর পানি নাই, হয়েছে ময়লার স্তর। নদী আর নদী নাই কোনটা মরে গেছে গেছে আর কোনটা কোনমতে বেঁচে রয়েছে মৃতপ্রায় খাল হয়ে।
এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন উপকূল রক্ষায় আমরা’র সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র, রিভার বাংলা সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ প্রমূখ।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস-২০২৫ পালন উপলক্ষে আজ ধরা, আমরা কলাপড়াবাসী এবং পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যৌথ উদ্যোগে আন্ধারমানিকসহ সকল নদীর দখল-দূষণ বন্ধ এবং নদীর সীমানা নির্ধারণের দাবিতে পটুয়াখলীর কলাপাড়ায় মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। আগামীকাল ও পরশু দেশের নানা জায়গায় ধরার বিভিন্ন শাখার উদ্যোগে নদীকৃত্য দিবস পালিত হবে।













